About সূরা আর-রূম
সূরা রুম বা রোমান সম্রাজ্য - ৩০
৬০ আয়াত, ৬ রুকু , মক্কী
[ দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে ]
ভূমিকা : পূর্বের ন্যায় এই সূরাতেও আলোচনা করা হয়েছে Ma'ad বা জীবনের শেষ পরিণতি সম্পর্কে , বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। পূর্বের সূরাতে বলা হয়েছে সময়ের পরিক্রমায় মানুষের জীবন কত দুর্বল। এই সূরাতে সময়ের পটভূমিতে মানুষের ক্রমবিকাশের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। মানুষ দুনীর্তির আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে, আল্লাহ্ তা পরিশুদ্ধ করেন। আল্লাহ্র বিশ্বজনীন পরিকল্পনা পরলোকের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। পরবর্তী দুইটি সূরাতে [ ৩১ ও ৩২ ] একই বিষয় বস্তুকে অন্য পটভূমিতে বর্ণনা করা হয়েছে। সুতারাং এই চারটি সূরার [ ২৯, ৩০, ৩১ ও ৩২ ] প্রারম্ভে আলিফ, লাম, মিম কে স্থাপন করা হয়েছে।
এই সূরার সময়কাল গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে। সূরাটি অবতীর্ণ হয় হিজরতের ৬ থেকে ৭ বৎসর পূর্বে। সম্ভবতঃ তা ছিলো ৬১৫ - ১৬ খৃষ্টাব্দ। সে সময়ে পারসিয়ানরা ছিলো অত্যন্ত শক্তিশালী এবং তারা রোম সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে। রোমের খৃষ্টান রাজা জেরুজালেমের অধিকার হারান এবং অগ্নিপূজক পারসিয়ানরা তা দখল করে। সে সময়ে এ কথা ধারণারও বাইরে ছিলো যে, শক্তিশালী পারসিয়ানদের কারও পক্ষে পরাজিত করা সম্ভব। মোশরেক কোরেশরা ছিলো পারসিয়ানদের সমর্থক , সুতারাং তারা পারসিয়ানদের বিজয়ে উল্লাসিত হয়ে ওঠে এবং রসুলুল্লাহ্র [ সা ] উপরে ব্যঙ্গ -বিদ্রূপ ও অপমানের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এর কারণ ছিলো রসুলুল্লাহ্র [সা] প্রচারিত বাণী ছিলো হযরত ঈসার জেরুজালেমে প্রচারিত বাণীর পুণর্জীবিতকরণ। উভয় বাণীই এক আল্লাহ্র নিকট থেকে আগত।
পারসিয়ানদের যুদ্ধ জয়ের সময়ে এই আয়াতগুলি [ ৩০ : ১ - ৬] অবতীর্ণ হয় যাতে পারসিয়ানদের পরাজয়ের পূর্বাভাষ দেয়া হয়েছে ; যা ছিলো পারস্য সাম্রাজ্য ধ্বংসের পূর্বাভাস। এই ভবিষ্যত বাণী ছিলো স্বয়ং আল্লাহ্ কর্তৃক দেয়া। সুতারাং তা যে কার্যকর হবে-ই সে সম্বন্ধে সন্দেহের কোন অবকাশ ছিলো না। তবুও মোশরেক কোরেশরা হযরত আবু বকরের সাথে এ ব্যাপারে বাজি রাখে এবং স্বাভাবিক ভাবেই বাজিতে হেরে যায়।
অবশ্য তখনও রসুলুল্লাহ্ [ সা ] তায়েফের ঘটনার [ হিজরতের দু বৎসর পূর্বে ] নিদারুণ যন্ত্রণার সম্মুখীন হন নাই বা হিজরতের প্রাক্কালে তাঁকে হত্যার যে ষড়যন্ত্র করা হয় তা করা হয় নাই। কিন্তু শত অত্যাচার, নির্যাতন, নিষ্পেশনেও আল্লাহ্র পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার নয়। বদরের যুদ্ধ [ ২য় হিজরী বা ৬২৪ খৃষ্টাব্দ ] ছিলো মুসলমানদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ যুগ সন্ধিক্ষণ। এখান থেকেই শুরু হয় বাইরের পৃথিবীর সাথে ইসলামের সমন্বয় সাধন এবং ভারসাম্য রক্ষা করার সিদ্ধান্ত। এটা ছিলো বাইরের ঘটনা, বৃহত্তর ঘটনা ঘটে চলেছিলো মানুষের মনোজগতে। এক বিশাল আধ্যাত্মিক জগতের সৃষ্টি হতে চলেছে। এই আধ্যাত্মিক বিপ্লব পৃথিবীর ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ইসলাম মিথ্যা উপাস্য ও পৌরহিত্যকে ছুঁড়ে ফেলে, ধর্মের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকতার পরিবর্তে ধর্মীয় বিশ্বাসে সহজ সরল জীবন ধারণ পদ্ধতি চালু করে। পৃথিবীর জীবন পরলোকের জীবনের জন্য শিক্ষানবীশ কাল মাত্র। এই বিশ্বাস ইসলামের মূল বিষয়বস্তু ; অন্ধ , কুসংস্কার এবং ধর্মীয় অনুশাসনের সুক্ষ চুলচেরা বিশ্লেষণকে ইসলাম প্রত্যাখান করে সেখানে প্রকৃত বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন জ্ঞানের সন্ধান করে, এবং প্রচার করে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কোন কর্মকান্ড ধর্ম নয়, ধর্ম হচ্ছে জীবনকে পরিচালনার ঐশী নির্দ্দেশ সমূহ। অর্থাৎ জীবন ও ধর্ম এক। ইসলামের মূল কথা হচ্ছে চিন্তা - অনুভূতি - কথা - কর্ম , সব এক সুতোতে গাঁথা। ইসলামের এই বিশ্বাস, সংগ্রাম পৃথিবীব্যপী চলছেই এবং চলবেই। শতাব্দীর শেষে এ কথার সত্যতা পৃথিবী ব্যপী ইসলামের প্রসারের মাধ্যমে প্রমাণ করে।
সারসংক্ষেপ : ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীতে ক্ষমতার উত্থান পতন ঘটে, - যা পারসিয়ান ও রোম সাম্রাজ্যের উত্থানপতনকে প্রতীক হিসেবে এখানে দেখানো হয়েছে। কিন্তু এই বাহ্যিক ঘটনাগুলি বিবরণের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে বিশ্বব্রহ্মান্ডে আল্লাহ্র অত্যাশ্চার্য কর্মপদ্ধতির গভীরতা বুঝানোর জন্য। দেখানো হয়েছে কি ভাবে ভালো ও মন্দ তাদের শেষ পরিণতি লাভ করে। [ ৩০ : ১ - ১৯ ]
আল্লাহ্র সৃষ্টিতে উত্থান পতন , শারীরিক , নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক যে কোনও পরিবর্তন সবই নির্দ্দেশ করে আল্লাহ্র একত্বের দিকে। মানব কখনও আল্লাহ্র একত্ব থেকে বিপথে যাবে না। বরং সে সেই বিশ্ব স্রষ্টার প্রশংসা করবে কারণ তাঁর সমকক্ষ কেউ নাই। [ ৩০ : ২০ - ৪০ ]
মানুষ পৃথিবীতে দুর্নীতি দ্বারা বিপর্যয় সৃষ্টি করে থাকে। আল্লাহ্ দূষিত প্রাকৃতিক পরিবেশ যে ভাবে পরিশুদ্ধ করেন, দুর্বলকে যে ভাবে সবল করেন, নির্দ্দিষ্ট সময়ের পরে শক্তিশালীকে যে ভাবে টেনে নামান, ঠিক সেই ভাবে আল্লাহ্ মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জগতকে পরিশুদ্ধ করেন। সুতারাং ধৈর্য, অধ্যাবসায় অবলম্বন কর, হতাশ হয়ো না। [ ৩০ : ৪১ - ৬০ ]।