About সূরা ইউসূফ
সূরা ইউসুফ -১২
ভূমিকাঃ- সূরা ১০ থেকে ১৫ পর্যন্ত সূরার সাধারণ মর্মার্থ এবং এই সূরার ক্রম অনুসারে এর অবস্থানের জন্য দেখুন ১০ এর ভূমিকা। এই সূরাতে পিতা ইয়াকুবের ১২টি ছেলের মধ্যে ইউসুফের কাহিনীর বিশেষ বিশেষ অংশকে তুলে ধরা হয়েছে। এই কাহিনীকে আল্লাহ্ অত্যন্ত সুন্দর কাহিনীরূপে উল্লেখ করেছেন [১২:৩] আয়াতে। কারণ হিসেবে বলা যায়; ১) কোরানে বর্ণিত অন্যান্য ঘটনার থেকে ইউসুফের কাহিনী অত্যন্ত বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ২)এই কাহিনীর মাধ্যমে মানুষের উত্থান পতনের বর্ণনা করা হয়েছে; ফলে স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে এর আবেদন পৌছায় । ৩) সুন্দর ভাবে অঙ্কিত করা হয়েছে এর আধ্যাত্মিক নিহিতার্থ, জীবনের বিভিন্ন দিক চিহ্নিত করা হয়েছে, বৃদ্ধ পিতার সন্তানের জন্য আকুতি, পিতা এবং তাঁর আদরের ছোট সন্তানের মধ্যে আস্থা ও ভালোবাসার সম্পর্ক, বড় ভাইদের ছোট ভাই এর প্রতি হিংসা-দ্বেষ, তাদের ষড়যন্ত্রের কারণে তাদের পিতার দুঃখ, নামমাত্র মূল্যে পিতার আদরের সন্তানকে দাসত্বের জন্য বিক্রী করা; ভালোবাসার কামজ প্রবৃত্তিকে পবিত্রতা ও সংযমের পটভূমিতে তুলে ধরা, মিথ্যা অভিযোগ, কারাগার, স্বপ্নের অর্থ, সাধারণ জীবন ও অর্থবহ জীবন ইত্যাদি। নিষ্পাপ জীবন সম্মান বয়ে আনে , ক্ষমা ও বদান্যতা প্রকাশ করা হয়েছে মিষ্টি প্রতিশোধ আকারে,প্রশাসনের উচ্চ কার্যাবলী, উচ্চপদে অধিষ্ঠানে থেকেও বিনয়, বাৎসল্য ও সর্বপরি ধর্মানুরাগ ও সত্যানুরাগ ইত্যাদির বর্ণনা এখানে আছে।
এই কাহিনী যদিও বাইবেলে বর্ণিত কাহিনীর অনুরূপ তবুও এই কাহিনী ও বাইবেলে বর্ণিত কাহিনী এক নয়। বাইবেলে বর্ণিত কাহিনী লোকগাঁথাকে স্মরণ করিয়ে দেয়- যেখানে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের কোনও স্থান নাই। সেখানে ইহুদীদের মিশরবাসীদের উর্দ্ধে স্থাপনের জন্য প্রয়াস পায় এ ভাবে যে ইহুদীরা মিশরবাসী অপেক্ষা অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও আর্থিক ব্যাপারে অত্যন্ত বিচক্ষণ ছিল । সেখানে দেখানো হয়েছে যে ইউসুফ দুভির্ক্ষের সুযোগ গ্রহণ করে গরীব মিশর বাসীদের জমি ও গৃহপালিত পশু হস্তগত করেন রাষ্ট্রের নামে। এভাবেই ইসরাঈলীরা ফেরাউনের পশুসম্পদের অধিকারী হয়, এখানেই বাইবেলের কাহিনীর সাথে কোরানের কাহিনীর পার্থক্য - কোরান কাহিনীর আধ্যাত্মিক দিকটি অল্প বর্ণনার মাধ্যমে তুলে ধরেছে। রূপক বর্ণনার মাধ্যমে জীবনের পরস্পর বিরোধী দিক তুলে ধরেছে, বলা হয়েছে অসত্য ও পরিবর্তনশীল পৃথিবীর মাঝে সত্যিকারের গুণাবলী একমাত্র স্থায়ী ভাবে থাকে। ইতিহাসের বিরাট ক্যানভাসে আঁকা হয়েছে; কিভাবে আল্লাহ্র পরিকল্পনা ধীরে ধীরে কার্যকররূপ গ্রহণ করে। মুসলিম ব্যাখ্যাকারীদের নিকট কাহিনীর এই বিশেষ দিক অত্যন্ত প্রিয় ।
সার সংক্ষেপঃ জীবন একটা স্বপ্ন যা উপমা ও কাহিনীর মাধ্যমে প্রাঞ্জল ভাষায় কোরানে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্র নবী হযরত ইউসুফ স্বপ্নে যে সত্যকে প্রত্যক্ষ করেন, তা তার সৎ ভাইদের কাছে অরুচিকর মনে হয়। তারা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এবং নামমাত্র মূল্যে তাঁকে বণিকদের কাছে ক্রীতদাসরূপে বিক্রী করে দেয় । [১২:১-২০]
বনীকেরা হযরত ইউসুফকে মিশরে নিয়ে আসে এবং মিশরের প্রধানমন্ত্রীর (আজিজ) সম্মুখে আনায়ন করে, পরবর্তীতে আজিজ হযরত ইউসুফকে দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন। আজিজের স্ত্রী হযরত ইউসুফকে প্রেমিকরূপে পেতে চান- কিন্তু কামজ প্রেমে হযরত ইউসুফকে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। তাঁর প্রত্যাখান তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করে। কিন্তু হযরত ইউসুফ কারাগারে থেকেও সত্যকে খুঁজে ফেরেন এবং সেখানে তিনি তার দয়ালু স্বভাবের জন্য পরিচিত ছিলেন। তাঁর একজন সঙ্গী -বন্দী, যার কাছে তিনি স্বপ্নের ব্যাখা দান করেছিলেন, মুক্তি পায় এবং রাজ অনুগ্রহ লাভ করে রাজার পানপাত্র বহনকারী হয়। [১২: ২১-৪২]
রাজার স্বপ্নের ব্যাখ্যা দানের সুযোগে ইউসুফ রাজার নিকট নিজের নির্দ্দোষিতা প্রমাণের সুযোগ পেলেন। হযরত ইউসুফ দাবী করলেন যে প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধ থেকে সকল অপবাদ মিথ্যারূপে ঘোষণা করা হোক । তিনি রাজ অনুগ্রহ লাভ করেন এবং উজির পদে মনোনীত হন। তাঁর সৎ ভাইরা দুর্ভিক্ষ পীড়িত হয়ে মিশর আগমন করে এবং ইউসুফ দ্বারা সহৃদয়তার সাথে গৃহিত হয়। তারা ইউসুফের পরিচয় জানতে পারে না । হযরত ইউসুফ তাঁর আপন ভাই বেঞ্জামিনকে মিশরে আনতে বলেন। [১২: ৪৩-৬৮]
হযরত ইউসুফ কৌশলে বেঞ্জামিনকে আটকিয়ে রাখেন এবং তাঁর সৎ - ভাইদের তাদের অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করে। পরে তাদের ক্ষমা করে দেয় এবং তাদের ক্যানন থেকে হযরত ইয়াকুব ও তাদের পরিবারদের মিশরে আনার জন্য প্রেরণ করেন । [১২: ৬৯-৯৩]
হযরত ইসরাঈল (ইয়াকুব) মিশরে এসে বসতি স্থাপন করেন ও শান্তি লাভ করেন। আল্লাহ্র নামকে মহিমান্বিত করা হয়। আল্লাহ্র সত্য চিরস্থায়ী হবে এবং আল্লাহ্র ইচ্ছা পরলোকে পূর্ণভাবে প্রকাশ করা হবে। [ ১২: ৯৪ - ১১১]